Guidelines

হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় কেন: কারণ ও করণীয়

হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় কেন: কারণ ও করণীয়

হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় কেন বা নিঃশ্বাসের কষ্ট হওয়া একটি ভীতিকর অভিজ্ঞতা। এই অনুভূতিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ডিসপনিয়া (Dyspnea) বলা হয়। আপনার যদি হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হয়, তাহলে এটি কোনো অন্তর্নিহিত রোগের লক্ষণ হতে পারে। বরং এটি বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার একটি গুরুতর লক্ষণ। অনেক সময় সাধারণ কারণে এটি হলেও, কখনো কখনো এটি মারাত্বক কোনো রোগের ইঙ্গিত বহন করে। তাই, হঠাৎ শ্বাসকষ্টের পেছনের কারণগুলো জানা এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় কেন:সাধারণ এবং গুরুতর কারণসমূহ –

শ্বাসকষ্টের কারণগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি, যা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।

জীবনযাত্রা ও পরিবেশগত কারণ –

অতিরিক্ত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম: হঠাৎ করে নিজের ক্ষমতার চেয়ে বেশি শারীরিক পরিশ্রম করলে ফুসফুসের উপর চাপ পড়ে এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

অ্যালার্জি: ধুলাবালি, ফুলের রেণু, পশুপাখির লোম বা নির্দিষ্ট কোনো খাবারের প্রতি অ্যালার্জির কারণে শ্বাসনালীতে প্রদাহ হয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হতে পারে।

অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা: শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমলে তা ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডের উপর চাপ সৃষ্টি করে, ফলে সামান্য পরিশ্রমেও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।

উঁচু স্থানে ভ্রমণ: পাহাড়ি বা উঁচু এলাকায় বাতাসের চাপ কম থাকায় এবং অক্সিজেনের ঘনত্ব কম হওয়ায় শ্বাসকষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।

ধূমপান ও বায়ুদূষণ: ধূমপানের অভ্যাস এবং দূষিত পরিবেশে বসবাস ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং হঠাৎ শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়ায়।

মানসিক কারণ –

উদ্বেগ ও প্যানিক অ্যাটাক (Anxiety and Panic Attack):

উদ্বেগ ও প্যানিক অ্যাটাক

মানসিক চাপ থেকে হঠাৎ প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে। এ সময় আপনার মনে হয় শ্বাস নিতে পারছেন না। এসময় হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, যা থেকে বুকে চাপ এবং শ্বাসকষ্টের অনুভূতি হয়। এটিকে হাইপারভেন্টিলেশনও বলা হয়। প্যানিক অ্যাটাকের সময় মনে হতে পারে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে বা হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। এটি সাধারণত ১০-২০ মিনিটের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।

শারীরিক রোগ ও জরুরি অবস্থা –

শ্বাসকষ্ট অনেক সময় গুরুতর কিছু রোগের লক্ষণ হতে পারে, যেগুলোর জন্য জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।

১. অ্যাজমা বা হাঁপানি:

এটি শ্বাসনালীর একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহজনিত রোগ। অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসনালী অত্যন্ত সংবেদনশীল হয় এবং কোনো উত্তেজক (ট্রিগার) এর সংস্পর্শে এলে তা সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে কাশি, বুকে সাঁ সাঁ শব্দ এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।

২. সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ):

সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ)

এটি ফুসফুসের একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ, যা মূলত ধূমপায়ীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এই রোগে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলো (অ্যালভিওলাই) ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না।

৩. হৃদরোগ (হার্ট ফেইলিওর):

যখন হৃদপিণ্ড শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত রক্ত পাম্প করতে পারে না, তখন ফুসফুসে রক্ত ও তরল জমতে শুরু করে। একে পালমোনারি ইডিমা বলা হয়, যা থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে রাতে ঘুমের মধ্যে বা শুয়ে থাকলে এই সমস্যা বাড়ে।

৪. নিউমোনিয়া:

ফুসফুসে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে প্রদাহ হলে তাকে নিউমোনিয়া বলে। এর ফলে ফুসফুসের বায়ুথলিতে তরল জমে এবং জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।

৫. পালমোনারি এমবোলিজম:

পালমোনারি এমবোলিজম

শরীরের অন্য কোনো অংশ থেকে, বিশেষ করে পা থেকে রক্ত জমাট বেঁধে (ব্লাড ক্লট) ফুসফুসের রক্তনালীতে আটকে গেলে তাকে পালমোনারি এমবোলিজম বলে। এটি একটি অত্যন্ত জরুরি অবস্থা, যেখানে হঠাৎ তীব্র শ্বাসকষ্টের সাথে বুকে ব্যথাও হতে পারে।

৬. অ্যানাফাইল্যাক্সিস:

কোনো ওষুধ, খাবার বা পোকামাকড়ের কামড়ের ফলে শরীরে তীব্র অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হলে তাকে অ্যানাফাইল্যাক্সিস বলে। এতে শ্বাসনালী ফুলে গিয়ে দ্রুত শ্বাসপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা জীবনহানির কারণ হতে পারে।

৭. অক্সিজেন কমে গেলে – 

অক্সিজেনের অভাবে আপনার ঠোঁট নীল হয়ে যায়। নখের রং পরিবর্তন হয়ে নীলচে হয়ে যায়। মাথা ঘোরা এবং দুর্বলতা অনুভব করেন। ক্লান্তি এবং অবসাদ দ্রুত চলে আসে। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক দ্রুত হয়ে যায়।

হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে তাৎক্ষণিক করণীয়: ৫টি জরুরি পদক্ষেপ

হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত থাকা সবচেয়ে জরুরি। আতঙ্ক আপনার শ্বাসকষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে শ্বাস-প্রশ্বাসকে সহজ করার চেষ্টা করুন।

১. শান্ত হয়ে স্থিরভাবে বসুন:

আতঙ্ক কমানোর চেষ্টা করুন। একটি আরামদায়ক চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন। আপনার ঘাড় এবং কাঁধের মাংসপেশী শিথিল বা আলগা করে দিন। এটি ফুসফুসকে প্রসারিত হতে সাহায্য করবে।

২. পার্সড-লিপ ব্রিদিং (ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়া):

পার্সড-লিপ ব্রিদিং

এই সহজ শ্বাস-ব্যায়ামটি শ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ফুসফুস থেকে জমে থাকা বাতাস বের করে দিতে অত্যন্ত কার্যকর।

  • প্রথমে নাক দিয়ে ধীরে ধীরে ২ সেকেন্ড শ্বাস নিন।
  • এবার ঠোঁট দুটিকে শিস দেওয়ার মতো গোল করুন এবং মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে ৪ থেকে ৫ সেকেন্ড ধরে শ্বাস ছাড়ুন।
  • যতক্ষণ না শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে, এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করুন।

৩. আরামদায়ক অবস্থানে সামনের দিকে ঝুঁকুন:

বসা অবস্থাতেই সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ুন। আপনি চাইলে একটি টেবিলের উপর কনুই রেখে তার উপর মাথা রাখতে পারেন। এই অবস্থানে বসলে ফুসফুসের উপর থেকে চাপ কমে এবং শ্বাস গ্রহণ সহজ হয়।

৪. মুক্ত ও বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণ করুন:

বদ্ধ ঘরে থাকলে দ্রুত দরজা-জানালা খুলে দিন। সম্ভব হলে বারান্দায় বা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ান, যেখানে তাজা বাতাস চলাচল করে। বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে সাহায্য করে।

৫. ইনহেলার ব্যবহার করুন (শুধুমাত্র অ্যাজমা রোগীদের জন্য):

আপনার যদি আগে থেকেই অ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা থাকে এবং চিকিৎসক আপনাকে একটি রেসকিউ ইনহেলার (Rescue Inhaler) দিয়ে থাকেন, তবে দেরি না করে সেটি নির্দেশিকা অনুযায়ী ব্যবহার করুন।

শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ এবং ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী সুস্থতা –

হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট বা শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি কমাতে এবং ফুসফুসকে দীর্ঘকাল সুস্থ রাখতে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তোলা অপরিহার্য। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধূমপান ত্যাগ করা, কারণ এটি ফুসফুসের সুস্থতার প্রথম এবং প্রধান শর্ত। এর পাশাপাশি, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিনের রুটিনে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন নিয়মিত হাঁটা বা সাঁতার কাটা, অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

একইভাবে, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসও অত্যন্ত জরুরি; অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ তাজা ফল ও শাকসবজি ফুসফুসকে বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখে। শরীরের সঠিক ওজন বজায় রাখাও শ্বাসযন্ত্রের জন্য উপকারী, কারণ এটি হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ কমায়। যাদের নির্দিষ্ট জিনিসে অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য অ্যালার্জেন (যেমন: ধুলাবালি, নির্দিষ্ট খাবার) শনাক্ত করে তা এড়িয়ে চলা আবশ্যক।

সবশেষে, যাদের অ্যাজমা, হৃদরোগ বা অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা রয়েছে, তাদের জন্য নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা এবং সময়মতো ওষুধ সেবন করা যেকোনো গুরুতর পরিস্থিতি এড়াতে সাহায্য করে। এই অভ্যাসগুলো সম্মিলিতভাবে ফুসফুসের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনে।

কখন জরুরিভাবে চিকিৎসকের কাছে যাবেন?

নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে একদম দেরি না করে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে:

  • হঠাৎ এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট।
  • শ্বাসকষ্টের সাথে বুকে তীব্র ব্যথা, চাপ বা অস্বস্তি।
  • শ্বাসকষ্টের সাথে ঠোঁট বা ত্বক নীল হয়ে যাওয়া।
  • মাথা ঘোরা, জ্ঞান হারানো বা বিভ্রান্তি।
  • প্রচুর ঘাম হওয়া এবং হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া।
  • শ্বাস নেওয়ার সময় সাঁ সাঁ বা ঘরঘর শব্দ হওয়া।
  • কথা বলতে বা বাক্য সম্পূর্ণ করতে কষ্ট হওয়া।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)-

হঠাৎ শ্বাসকষ্ট কি হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ?

হ্যাঁ, হঠাৎ তীব্র শ্বাসকষ্ট হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম লক্ষণ। বিশেষ করে বুকে ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ঘাম, বমি বমি ভাব এবং বাম হাতে ব্যথা থাকলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেশি।

প্যানিক অ্যাটাকে শ্বাসকষ্ট কতক্ষণ স্থায়ী হয়?

প্যানিক অ্যাটাকের শ্বাসকষ্ট সাধারণত ৫-২০ মিনিট স্থায়ী হয়। এটি জীবনের জন্য বিপজ্জনক নয় তবে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। গভীর শ্বাস নিয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করুন।

অ্যাজমা রোগীরা হঠাৎ শ্বাসকষ্টে কী করবেন?

অ্যাজমা রোগীদের সবসময় ইনহেলার সাথে রাখা উচিত। অ্যাটাকের সময় দ্রুত ইনহেলার ব্যবহার করুন। উন্নতি না হলে জরুরি চিকিৎসা নিন। নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন।

শিশুদের হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে কী করব?

শিশুর শ্বাসকষ্ট হলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। শিশুকে সোজা করে ধরুন এবং শান্ত রাখুন। কোনো বস্তু গলায় আটকে থাকলে সতর্কতার সাথে বের করার চেষ্টা করুন।

কোভিড-১৯ এ শ্বাসকষ্টের লক্ষণ কেমন?

কোভিড-১৯ এ শ্বাসকষ্ট ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জ্বর, কাশি এবং গলা ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট হয়। অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং বুকে চাপ অনুভব হয়। এই লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে পরীক্ষা করান।

Read: ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ কেন হয় ও করণীয়?

উপসংহার:

পরিশেষে, হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় কেন বা হঠাৎ শ্বাসকষ্ট একটি অস্বস্তিকর ও ভীতিকর অনুভূতি হলেও এর কারণ জানা থাকলে সঠিকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব। ঘরোয়া উপায়ে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেলেও গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অপরিহার্য। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি কমানো যায়। হালকা শ্বাসকষ্টকে অবহেলা না করে এবং গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আপনি একটি সুস্থ ও নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারেন।